নবযাত্রা প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের চৌমুহনী পীরবাড়ির মেজবানির মাংস চার কারণে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে । ২৪ বছর ধরে চাঁটগাঁইয়া মেজবানির স্বাদ ও সুঘ্রাণের জন্য খ্যাতি ছিল নগরীর চৌমুহনীর পীরবাড়ি ও মাঝিবাড়ির মেজবানির মাংস। তবে প্রতিবছর রোজা উপলক্ষ্যে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আয়োজন করা ঐতিহ্যবাহী এ মেজবানির মাংস এখন প্রায় অর্ধেকের বেশি ক্রেতা হারিয়েছে। উল্লেখ্যযোগ্য চারটি কারণ হচ্ছে, করোনার কারণে মানুষের আয় কমেছে কিন্তু বেড়েছে দ্রব্যমূল্যের দাম। এক সময় প্রতিদিন গরু জবাই করেই তাজা মাংস দিয়ে এখানে রান্না করা হতো এ মাংস তবে অভিযোগ রয়েছে এখন আমদানি করা প্যাকেটজাত বা ফ্রিজে সংরক্ষণ করা মাংসে রান্না করা হচ্ছে। তাই কমেছে মাংসের আসল স্বাদ ও সুঘ্রাণ। এখন শুধু বিখ্যাত চৌমুহনী পীরবাড়িতেই নয়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেল এবং নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে রোজার মাসে বিক্রি করা হচ্ছে মেজবানি মাংস। এসব কারণে কমেছে ক্রেতা।
ঐতিহ্যবাহী মেজবানির মাংস রান্নার আয়োজনকারী পীরবাড়ি ও মাঝিবাড়ির বাসিন্দারা বলেন, গত ২৪ বছর ধরে রোজার মাসে আমরা এ মেজবানির মাংসের আয়োজন করে আসছি। এখনো পর্যন্ত আমরা কোনো প্যাকেটজাত বা ফ্রিজের মাংস দিয়ে মেজবানির মাংস রান্না করিনি। এমন কথা সত্য নয়। তবে এখন ক্রেতা কমেছে করোনার কারণে। অনেকে আয় কমেছে কিন্তু বেড়েছে দ্রব্যমূলের দাম। ২৪ বছরের মধ্যে গেল দুই বছর করোনার কারণে আয়োজনটি বন্ধ ছিল। এবছর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় প্রথম রোজা থেকে আবার শুরু হয়েছে বিক্রি। ক্রেতা কমেছে কারণ আগে শুধু পীরবাড়ি আর মাঝিবাড়ির বংশদরাই এটি করতো। এখন ব্যবসায়িক চিন্তায় এখানেই ৫-৮ দোকান রোজায় এ মাংস বিক্রি করছে।
পীরবাড়ির সদস্য মো. তৌসিফ বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ মাংসের রান্না প্রথম থেকে যেভাবে করা হত এখনো সেভাবে করা হয়। তবে এখন আর প্রতিদিন গরু জবাই করে করা হয় না। কারণ এখন মানুষের আয় কমেছে তাই চাহিদা কমেছে। একটা গরু জবাই করলে একদিনে শেষ হয় না। তাই আমরা কর্ণফুলি কাঁচাবাজারের কসাই থেকে মাংস কিনে মেজবানির মাংস রান্না করি। তিনি বলেন, দুই বছর আগে প্রতিদিন ৭০-৮০ কেজি মাংস রান্না করা হত। এখন ক্রেতা কমায় প্রতিদিন ৩০-৪০ কেজি মাংস রান্না করা হয়। চনার ডাল আগে রান্না হত ৪০-৫০ কেজি এখন রান্না হয় ৩০-৩৫ কেজি।
মাঝিবাড়ির সদস্য ফরহাদ আহমেদ সিফাত বলেন, আগে দিনে সব খরচ শেষে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার মত লাভ থাকতো। রোজার এক মাসে প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হত। আর এখন দিন ১ থেকে ১৫শ’ টাকা তুলতেও কষ্ট হয়। মাস শেষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার উঠে কি না সন্দেহ। ২২ বছর ধরে রোজার এক মাসে প্রায় ২০টা গরুর মাংস রান্না হত। এবছর হয়তো পাঁচটার মত হতে পারে। আমরা মেজবানির মাংস নিয়ে ব্যবসা করছি না। এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য তাই বংশপরম্পরায় ধরে রাখছি মাত্র।
বাড়ির আরেক সদস্য শাফাত আল আলম বলেন, আমাদের থেকে দেখে এখন শহরের বিভিন্ন জায়গায় ও হোটেলগুলোতে মেজবানির মাংস রান্না হচ্ছে। কিন্তু এ মাংসে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানির স্বাদ নেই। মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে আস্থা হারাচ্ছেন। একারণে আমরাও ক্রেতা হারাচ্ছি। আমরা এখনো তাজা গরুর মাংস, দেশীয় সরিষার তেল দিয়ে মেজবানির মাংস রান্না করছি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিকেল হয়ে ইফতারের সময় প্রায় আগত। কিন্তু ১০-৩০ মিনিট পর পর দু-এক জন করে ক্রেতা আসছে আর এক কেজি কিংবা হাফ কেজি করে মেজবানির মাংস বা চনার ডাল কিনছেন। অথচ দুই বছর আগেও রোজার দিনে দুপুর ২টা থেকে ইফতারের আগ মুহুর্ত ক্রেতার চাপে দম ফেলার সময় ফেতনা বিক্রেতারা। এখন এক কেজি মেজবানির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায় ও চনার ডাল ২২০ টাকা। দুই বছর আগে প্রতিকেজি মেজবানির মাংস ছিল ৬৫০ টাকায় ও চনার ডাল ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আগ্রাবাদ কেপিএমজি রহমান রহমান হক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন অফিস শেষে বাসায় ফিরার সময় ইফতারের জন্য মাঝিবাড়ির রান্না করা মেজবানির মাংস ও চনার ডাল কিনতে আসেন। তিনি বলেন, আমার এখানের মাংস ভালো লাগে তাই এখনো এখান থেকেই নিয়ে যাই।