তালেবানের কাবুল জয়

নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া

সম্প্রতি বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের দৃষ্টি ও আলোচনার বিষয় ছিল তালেবান এবং আফগানিস্তানের দিকে। কারন দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তানে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। এর আগে তালেবান প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে আবার ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়। ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকারকে সাহায্য করতেই আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন আফগান মুজাহিদিনদের হাতে মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন সোভিয়েতপন্থী সরকারের পতন হয়। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করে। তবে এর ভিত্তি অনেক আগেই পাকিস্তানি শরণার্থী শিবিরে স্থাপন হয়েছিল যখন ১৯৭৯ সালে অনেক আফগান সোভিয়েত আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছিল। তালেবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ‘ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে’ দেশ চালাবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে, শান্তিপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তালেবানের এই প্রতিশ্রুতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এরপর কয়েক মাসের লড়াইয়ে তারা দেশের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানির সরকারকে উৎখাত করে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তবে কিছু কিছু বিষয়ে খুব কড়াকড়ি আরোপ করেছিল যেগুলো পশ্চিমা দেশগুলো ভালোভাবে নেয় নি। বিশ্লেষকদের মতে, তালেবানের সরকারব্যবস্থা আধুনিক ছিল কিন্তু তাদের অনুশাসন ছিল গোড়া। তারপরও ক্ষমতায় এসে সাময়িকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তালেবান। কারন তারা দুর্নীতি দমনে সাফল্য দেখিয়েছিল, আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিল, অবকাঠামো নির্মাণে হাত দিয়েছিল, তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ দিয়েছিল। ১৯৯৮ সাল নাগাদ আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। মানবাধিকার লংঘনের জন্য আফগানিস্তান জাতিসংঘের স্বীকৃতি হারিয়েছিল এবং ইরান, ভারত, তুরস্ক, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশ তালিবান শাসনের বিরোধিতা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইনটাওয়ার হামলার পর প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে আল-কায়েদা এবং এর নেতা ওসামা বিন লাদেন আলোচনায় আসেন। তৎকালীন তালেবান সরকারকে আল-কায়েদার আশ্রয়দাতা অভিযোগেই ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে প্রথম বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এরপর ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর তালেবান সরকারের পতন হয়। সে সময় তালেবানের শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমর, আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনসহ বেশ কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা আফগানিস্তান ছেড়ে তৃতীয় দেশে পাড়ি জমান। সেখান থেকে তাঁরা সংগঠন পরিচালনা করতেন। দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধ করেও যুক্তরাষ্ট্র সফল হতে না পেরে অবশেষে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়, তার শর্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং তালেবানও আর মার্কিন বাহিনীর ওপর কোন হামলা চালাবে না। কারণ, যে হারে তারা তালেবানদের কাছে সৈন্য হারাচ্ছিল, তাতে মানসম্মান নিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করা ছাড়া তাদের উপায় নেই। মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়া শুরু করতেই সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে তালেবানরা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটির ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১৮টি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু এরপর কার্যত ঝড়ের গতিতে এগোতে শুরু করে দলটি। একে একে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয় তারা। কাবুলের প্রবেশপথ মাজার-ই-শরিফ দখলের পর থেকেই কাবুলের পতন ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। জালালাবাদ দখলের মাধ্যমে আফগান সরকারের চূড়ান্ত পতন শুরু হয়। অবশেষে গত ১৫ আগস্ট বিনা বাধায় কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারবোন। ওই দিনই দেশ ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। তালেবান সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সবাইকে কাজে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে। তালেবান মুখপাত্র সুহেল শাহীন বলেন, আফগানিস্তানের জনগনের সম্পত্তি-জীবন নিরাপদ। কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। আমরা জনগন-দেশের সেবক। তালেবান কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে দেশটির সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ উচ্চশিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। তালেবানের নীতি হচ্ছে কারও দেশ ছাড়া উচিত নয়; সবার মেধা ও দক্ষতা দেশের জন্যই প্রয়োজন। এছাড়া সংবাদ সম্মেলেেন তালেবান বলেছেন, অভিজ্ঞতা, পরিপক্কতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে বিশ বছর আগের তালেবানের সাথে আজকের তালেবানের বিশাল তফাত রয়েছে। এটা বিবর্তনের ফসল। এবার তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবেন, যেতে পারবেন ঘরের বাইরেও। এক্ষেত্রে বোরকা বাধ্যতামূলক নয়, কেবল হিজাব পরলেই চলবে। নারী শিক্ষার বিষয়ে তালেবানের ইতিবাচক নীতির কথা এর আগে মস্কো ও দোহা সম্মেলনেও বলা হয়েছে। নারীরা আমাদের সাথে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে যাচ্ছে। নারী-পুরুষে কোনও বৈষম্য থাকবে না। তালেবান তাদের সরকারে নারীদের যোগ দিতে আহবান জানিয়েছে। তালেবানকে সবাইকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করতে হবে। এ নীতির মাধ্যমে তারা মধ্যপন্থী হয়ে বিশ্বের সমর্থন চায়। তালেবানদের এত দ্রুত অগ্রসর হতে পারার অন্যতম কারণগুলো হলো- দুর্বল আফগান সেনাবাহিনী, অকার্যকর বিমানবাহিনী, তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের গোপন সমর্থন, আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে নতুন কৌশল, পুরনো যুদ্ধবাজদের বিশৃঙ্খলা এবং যুদ্ধক্লান্ত জনগোষ্ঠী মুখ্য। এছাড়া আফগান সরকারের মতো সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনীও দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং গুরুতর আমলাতন্ত্রের ডামাডোলে ভুগছে। আবার প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তালেবান বাহিনীর পাশাপাশি উত্তর-জোট গঠনকারী যুদ্ধবাজদেরও বিরোধিতা করেছেন যা যুদ্ধবাজদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্ধের সৃষ্টি করেছে। তালেবানদের ঠেকাতে আশরাফ গনি তাদের একত্রিত করার জন্য যা করতে পারতেন, তা করেননি। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল জুড়ে উড়ছে তালেবানদের বিজয় পতাকা। আফগানিস্তানে তালেবানের অবিশ্বাস্য সামরিক সাফল্যের দিকে পুরো বিশ্বই এখন হা হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। অধিকাংশ পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষক এখন বলছেন, ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে গত ২০ বছর ধরে ক্রমাগত আমেরিকা এবং ন্যাটো বাহিনীর তাড়া খেয়ে বেড়ানোর পরও গত ২০ বছরের মধ্যে তালেবান এখন সবচেয়ে শক্তিধর। গত ১০ বছর ধরে ধীরে ধীরে এগিয়েছে তারা। তালেবান জানত আমেরিকা একসময় আফগানিস্তান ছাড়বেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিল তারা। আমেরিকানদের কৌশল ছিল আফগানিস্তানের প্রধান শহরগুলোকে কব্জায় রাখা কিন্তু শহরের বাইরে গ্রামগঞ্জ তালেবানের নিয়ন্ত্রণে থেকে গিয়েছিল। তারপর একসময় যখন আমেরিকা নিরাপত্তার দায়িত্ব আফগান সেনাবাহিনীর ওপর ছেড়ে দিতে শুরু করল, তালেবান তখন আস্তে আস্তে শহরগুলো নিশানা করতে শুরু করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্য ক্ষমতাসীন হবার পর ঘোষণা করেন ২০২১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সব মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরিয়ে আনবেন। তখন থেকে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ঘুম হারাম করে দিয়েছে তালেবান। রণকৌশলে খুবই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে তালেবান। তালেবান মূলত জাতিগত পশতুন এবং কট্টর সুন্নি ওয়াহাবি হিসাবে পরিচিত হলেও গত কয়েক বছর ধরে তারা আফগানিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেমন হতাশ তাজিক, তুর্কমেন এবং উজবেক গোষ্ঠী নেতাদের কাছে টেনেছে। ফলস্বরূপ দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ারের সঙ্গে লড়াই করে তালেবান শুধু টিকেই থাকেনি, বরং তারা নতুন করে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। মার্কিন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা সেনা প্রত্যাহারকে আমেরিকার ‘পরাজয়’ ও ‘পশ্চাদপসরণ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবেই বহিরাগত হানাদারদের জন্য কঠিন স্থান। এর কারণ হলো- এর জটিল গোত্রীয় সমীকরণ, এর দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। এটি হলো ভূগোলে নির্ধারিত ভূরাজনীতির নিয়তির অনন্য উদারহণ হলো এই দেশ। আফগানদের সাময়িকভাবে কব্জা করা গেছে কিন্তু সবাইকে শেষ পর্যন্ত পালাতে হয়েছে। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশ গিয়েছিল আফগানিস্তান দখল করতে, ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিল এবং ২০০১ সালে আমেরিকা গিয়েছিল- সবাইকে একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে এখন তালেবানরা বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে আফগানিস্তানের উন্নয়ন, গঠন এবং শান্তিপ্রক্রিয়ায় তালেবানদের বাদ দেওয়া সম্ভব না। প্রতিবেশী ইরান, চীন, রাশিয়া, সেন্ট্রাল এশিয়া, পাকিস্তান সবাই একমত যে জাতি গঠনে তালেবানদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা রয়েছে। এটাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ আছে। এখন তালেবানরা বিশ্ব সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখে। এছাড়াও তালেবানকে জঙ্গী হিসেবে পরিচিত করেছে পশ্চিমা মিডিয়া। আর পশ্চিমা মিডিয়া কখনই ইসলামের পক্ষে ছিল না। পশ্চিমাদের বিরোধী হলেই জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে অত্যাচার শুরু হয়। তালেবানরা যদি সন্ত্রাসী হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে তো গড়ে তুলেছে আমেরিকা। আমেরিকা যখন সোভিয়তকে দমন করার প্রয়োজন হল তখন তালেবানকে অস্ত্র, অর্থসহ যাবতীয় সহায়তা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন আমেরিকার বিরুদ্ধে গেল তখনই তালেবান জঙ্গী হয়ে গেল। নাইন ইলেভেন হামলা ইস্যুকে কেন্দ্র করে একটি দেশের ওপর বর্বর হামলা করা কি কোন ধরনের সন্ত্রাস নয়? আসলে তালেবান সন্ত্রাসী না; আমেরিকা-ইজরাইলই প্রকৃত জঙ্গি-সন্ত্রাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *