টুম্পা জয় করল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা

ইচ্ছে থাকলেই যেকোনো প্রতিবন্ধকতা অনেক দুর এগিয়ে যেতে পারে
নারীরা। তাহলেই সাফল্য ধরা দিবে।

মরিয়ম জাহান মুন্নী

চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অবস হয়ে যায় শরীর। গরীব বাবা তাঁর শেষ সম্বল জমি বন্ধক রেখে কলকাতায় নিয়ে আড়াই বছর চিকিৎসা করেন মেয়ের। চিকিৎসায় একটা সময় উঠে বসতে পারলেও হারিয়ে ফেলেন দু’পা এক হাতের ক্ষমতা। দেশে ফিরে আবার পড়াশোনার ইচ্ছে জানায় বাবাকে। বাবাও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে মেয়েকে ভর্তি করান। কিন্তু দুঃখ তার পিছু ছাড়েনি। মারা যায় বাবা। এবার একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। তবে কোনো কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারনি। একের পর এক বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ইচ্ছে শক্তির বলে তিনি ঠিক চালিয়ে গেছেন পড়ালেখা। হয়েছেন মানুষ গড়ার কারিগর। এখন তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক। লড়াই করে এতদূর আসা এই নারী বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ছয় নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা টুম্পা সেন গুপ্তা।
অদম্য এই নারী শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর দারিদ্রতাকে জয় করে হয়েছে সফল শিক্ষিকা। তাঁর সেই কষ্টের পুরষ্কারও পেয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালে মা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের বোয়ালখালী উপজেলা থেকে শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সেরা পাঁচ জয়িতার একজন নির্বাচিত হয়ে সম্মাননা অর্জন করেন।
তাঁর পথচলা সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষিকা টুম্পা সেন গুপ্তা বলেন, চার ভাই তিন বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত অন্য সবার মতো স্বাভাবিকভাবেই লেখাপড়া, খেলাধুলা করতাম। স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে পুরষ্কার ফেতাম। কিন্তু ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের কিছুদিন পর জ্বর হয় এবং ডাক্তারও জ্বর কমাতে পারছিলনা। তখনই জীবনটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় আমার। সেই জ্বরে শরীর অবশ হয়ে যায়। উঠে বসার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।
তিনি বলেন, আমার গরীব বাবা এলাকার একজনের কাছে তার যে জমি ছিল সেগুলো বন্ধক রাখেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি বাবার সাথে বেইমানি করে বন্ধকের বদলে টিপসই নিয়ে সব জমি নিয়ে নেয়। তখন বাবা সেটি বুঝেনি। সেই টাকায় কলকাতায় আমার চিকিৎসা চলে। এরপর উঠে বসতে পারলেও বাম হাত ও দু’পায়ের জোর আর ফিরে আসেনা। এটাই ভাগ্য মেনে দেশে ফিরে আসি। বাবাকে বলি পড়ালেখা করতে চাই। তিনি আমাকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করান। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আমাকে পড়াশোনা করানোর অবস্থা বাবার ছিল না। তাই অন্যের পুরান বই নিয়ে পড়ালেখা করি। খুব ইচ্ছে করতো প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যেতে। শিক্ষকরা কি পড়াচ্ছেন দেখবেন, শুনবেন। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য বিদ্যালয়ে যাওয়া হত না। শুধু পরীক্ষার সময় ভাইদের কোলে ছড়ে পরীক্ষা দিতে যেতাম। পরীক্ষা শেষ অপেক্ষা করতাম কখন কে আসবে আর আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। এভাবে ২০০৮ সালে বিএসএস পাশ করি। ২০১৩ সালে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়। নতুনভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগল। চাকরির পরই প্রথম হুইল চেয়ার ব্যবহার করি। সেই হুইল চেয়ারে বসে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে যাই। মনে হল অন্ধকার পৃথিবীটা এক নিমিষেই আলোয় ভরে উঠেছে। তিনি বলেন, এখন আমি গরীব শিক্ষার্থীদের যতটা সম্ভব বিনামূল্যে পড়াই। ভবিষ্যৎতেও তাদের পড়াতে চাই। আবার যাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে তাদের জন্য আরো বেশি যতœশীল হই।
কর্মক্ষেত্র নিয়ে টুম্পা বলেন, যেহেতু আমি অন্য ১০ জনের মত নই এক্ষেত্রে আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সহকর্মীরা যাতাযাতে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেন। আমিও মেধা দিয়ে আমার প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার চেষ্টা করি। এ আন্তরিকতার জন্য আমি সবার কাছেই কৃতজ্ঞ।
শিক্ষিকা টুম্পা সেন গুপ্তা নারীদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, প্রতিটি মানুষের জীবনে কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে। নারীদের জীবনে নেই প্রতিবন্ধকতা আরো বেশি। আবার যারা আমারই মত শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছে তাদের জীবন আরো কঠিন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই অনেক দুর এগিয়ে যেতে পারে নারীরা। তাহলেই সাফল্য ধরা দিবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *