নবযাত্রা ডেস্ক
পৃথিবীকে নিরাপদ এবং বাসযোগ্য রাখতে জলবায়ু সংকট এবং পরিবেশ দূষণ রোধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’-এ এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিপাদ্যটি হলো— ‘আমাদের শক্তি, আমাদের পৃথিবী’। পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার অঙ্গীকারে বিশ্বের নানা প্রান্তে পালিত হচ্ছে এ বিশেষ দিনটি।
দিবসটি প্রথম উদ্যাপিত হয় ১৯৭০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর গে লর্ড নেলসন এই দিবসের প্রবর্তন করেন। পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সে দেশে তিনিই প্রথম জনমত গড়ে তোলেন।
তার নেতৃত্বে তৎকালীন সময়ে জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দুই কোটি মানুষ। সেই থেকেই দিবসটির সূত্রপাত।
দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়, বন উজাড়, প্লাস্টিক দূষণ ও অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বর্তমান প্রজন্মের সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া টেকসই পৃথিবী নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে বাংলাদেশসহ প্রায় প্রতিটি দেশ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি আয়োজন করেছে নানা কর্মসূচির।
বড় প্লাস্টিক চোখে দেখা যায়। এ কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপদ কেমন হতে পারে– সে ধারণা কম-বেশি সবারই জানা। তবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রাণ-প্রকৃতিতে নীরবে বিষ ঢাললেও এর ভয়াবহতা থেকে যাচ্ছে আড়ালেই। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে– লবণ, আটা, চিনি, মাছ, মাটি, বাতাস, নদী, সমুদ্র এমনকি খাবার পানিতেও রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব।
২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে উৎপাদিত সামুদ্রিকআকার ৫ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট হয়। দিনের পর দিন শরীরে এই বিষ মিশতে থাকলে দেহে মরণব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে। বিপজ্জনক মাইক্রোপ্লাস্টিক ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বের প্রথম দেশ বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। উপকূলীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকেও লাগাম টানা হয়েছে। পলিথিন আর প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে চলছে অভিযান। তবু থামছে না এর ব্যবহার। সরকার এ ব্যাপারে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও মানুষকে এখনও সচেতন করা যায়নি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুসারে, প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। ২০৫০ সালে সাগরে যত মাছ থাকবে, তার চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক। প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম।
সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিথিন ও মাইক্রোপ্লাস্টিক যে কতটা ক্ষতিকর, তা জনগণকে অনুধাবন করতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মানুষের মনোজগতে। সবাই মিলে কাজ করলে প্লাস্টিকের সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
এ পটভূমিতে আজ মঙ্গলবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে।
২০২৩ সালের আগস্টে নেদারল্যান্ডসের সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি দেখা গেছে। গঙ্গা অববাহিকার নদীর প্রতি ২০ লিটার পানিতে অন্তত একটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। প্রতি কিলোগ্রাম পলিতে মিলেছে ৫৭টি কণা। আর বাতাসে প্রতি বর্গমিটারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার সংখ্যা ছিল ৪১।
গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, গঙ্গা নদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে রেয়ন। লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়েছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) গবেষকরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ১২টি লবণ উৎপাদনকারী স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা লবণের প্রতি কেজিতে ৫৬০ থেকে ১ হাজার ২৫৩টি প্লাস্টিক কণা শনাক্ত করেছেন।
লবণের ওপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পরিবেশ বিজ্ঞানী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আরেকটি গবেষণা করেছেন। সেখানে বলা হয়, বাজারের সুপরিচিত ১০টি ব্র্যান্ড ও খোলাবাজার থেকে সংগৃহীত নমুনায় দেখা গেছে প্রতি কেজি লবণে রয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি প্লাস্টিকের কণা। এই হিসাবে দেশের একজন মানুষ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক খাচ্ছে।
শুধু লবণ নয়, চিনি এমনকি টি-ব্যাগেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। ২০২২ সালের মে মাসে ‘ইজ দেয়ার টি কমপ্লিমেন্টেড উইথ দি অ্যাপেইলিং ফ্লেভার অব মাইক্রোপ্লাস্টিক? এ পায়োনিয়ারিং স্টাডি অন প্লাস্টিক পলিউশন ইন কমার্শিয়ালি এভেইলেবল টি-ব্যাগস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টে’ প্রকাশিত হয়। চিনি ও টি-ব্যাগ নিয়ে দুটি গবেষণাতেই অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষক। রাজধানীর বিভিন্ন সুপারমার্কেট থেকে সংগ্রহ করা পাঁচটি ব্র্যান্ড ও দুটি নন ব্র্যান্ডের চিনির প্রতি কেজিতে গড়ে ৩৪৩.৭টি প্লাস্টিক কণা পেয়েছেন গবেষকরা। নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত পাঁচটি ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগেও প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। বাজারে পাওয়া যায় এমন দেশি মাছের ওপর গবেষণা করে জানা যায়, ১৫ প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে।
সমুদ্রের গভীরতা থেকে আর্কটিক বরফ পর্যন্ত সর্বত্র প্লাস্টিকের ঝুঁকি রয়েছে। ফলে সুন্দরবন এর ব্যতিক্রম হবে– এমনটা আশা করা যায় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রাজিলের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দরবনের মাছ নিয়ে যৌথভাবে গবেষণা করে। পশুর, রূপসা ও মোংলা নদী থেকে ২০ প্রজাতির ১৪১টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের তিনটি প্রধান নদী থেকে অন্তত ১৭ প্রজাতির মাছ ও ৩ প্রজাতির সেলফিশ মাইক্রোপ্লাস্টিকে সংক্রমিত।
ঢাকার ১৩টি এলাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বাতাসে জরিপ করে অতি ক্ষুদ্র বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা পাওয়ার তথ্য উঠে আসে ২০২৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণায়।
২০২৩ সালে ঢাকা শহরের তিনটি লেকের পানি, মাটি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ নির্ণয়ের জন্য আরেকটি গবেষণা করা হয়। এসব লেকে দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ লোড সূচক অনুযায়ী এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে রয়েছে।
এ ছাড়া কর্ণফুলী নদীর পানি, মাটি ও মাছেবুড়িগঙ্গা নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর হুমকির মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়, একজন ব্যক্তি প্রতিবছর এ নদীর মাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার ৬৬০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এদিকে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ডিম্বাণু-শুক্রাণুতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে প্লাস্টিক কম দামি মনে হলেও পরিবেশ আর স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় মোটেও সাশ্রয়ী নয়। সরকার চেষ্টা করছে, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার থেকে মানুষকে সরিয়ে আনতে। পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত সুপারশপে সফল হলেও অন্য জায়গায় আরও কাজ করতে হবে। কারণ পলিথিনের নেতিবাচক দিকগুলো মানুষ জানে না। সেক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগসহ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধ করার চেষ্টা করব।