ভাস্কর্য বনাম মূর্তি: আবেগ ও বাস্তবতা

নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া

ভাস্কর্য এক ধরনের শিল্পকর্ম যা উন্নত রুচিবোধের পরিচয় বহন করে। শিল্পের কাজ হচ্ছে মানুষকে আনন্দ দেয়া এবং সৌন্দর্য উপলব্ধি করানো। ত্রি-মাত্রিক শিল্পকর্মকে ভাস্কর্য বলে। অর্থাৎ, জ্যামিতিশাস্ত্রের ন্যায় ভাস্কর্যকে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা সহ ত্রি-মাত্রিক হতে হবে। ভাস্কর্য শিল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার বছর পূর্বের বিভিন্ন সভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তার নান্দনিকতা-দর্শনীয়তা ও রুচিবোধের নিদর্শন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূর্তি এবং ভাস্কর্য সমার্থক। যে মূর্তি বা ভাস্কর্যকে ধর্মীয় রীতিতে পূজা করা হয় তাই প্রতিমা। বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি মুসলিম প্রধান দেশ সৌদি আরব, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, মিসর, ইরাকের জাদুঘরে ও উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য এবং প্রাচীন শাসক ও দেব- দেবীর মূর্তি। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও অসংখ্য ভাস্কর্য আছে। তবে ২০২০ সালে ভাস্কর্য ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজপথ উত্তাল হয়েছিল। ইসলামে ভাস্কর্য নির্মাণ ‘নিষেধ’ উল্লেখ করে তা বন্ধের দাবি তোলেন আলেম সমাজ। ভাস্কর্য ইস্যুতে আলেমদের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, কোনো মুসলিম দেশে ভাস্কর্য থাকার মানে এই নয় যে, ইসলাম এটাকে অনুমোদন করে। ইসলামের গাইডলাইন আসে কুরআন ও হাদিস থেকে। একাধিক নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, ইসলাম কঠোরভাবে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর ত্রি-মাত্রিক ইমেজ তৈরিতে নিষেধ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, হাদীসে জানা যায়, অতীতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে মূূর্তিপূজা তথা শিরকের সূত্রপাত ঘটেছে শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও অনুপ্রেরণা লাভের উদ্দেশ্যে প্রয়াত বিশিষ্ট জনদের ছবি টাঙানো বা ইমেজ তৈরির মধ্য দিয়েই। ইসলামে শুধু প্রাণীর ভাস্কর্য নিষিদ্ধ অর্থাৎ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে তবে অন্যকিছুর ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মাজীদ এবং হাদিসে প্রাণীর মূর্তি পরিহার করার স্পষ্ট নির্দেশ আছে। মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। বর্তমান ভাস্কর্য ইস্যুটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যেহেতু এখানে মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জড়িয়ে আছে। সরকার সমর্থিত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে আলেমদের বক্তব্যের প্রতিবাদ এবং আলেমদের গ্রেফতারের দাবিও উঠেছে। সরকারপক্ষ যে কোনো মূল্যে ভাস্কর্য নির্মাণ এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে আলেমরা ভাস্কর্য মাত্রেরই ঘোর বিরোধী। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ-মিছিলে কেঁপে উঠছে রাজপথ। রীতিমতো যুদ্ধংদেহী অবস্থা! ইতিমধ্যে এই বিষয়ে আলেমদের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে। ফলাফল যাই আসুক সংঘাত-সংঘর্ষ কোনভাবেই কাম্য নয়। দেশের আলেম-ওলামা যদি মনে করেন ভাস্কর্য নির্মাণ সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, তাহলে সরকার প্রধানের কাছে ধৈর্য্য ও বিজ্ঞতার সাথে ইসলামের শিক্ষা তুলে ধরাটাই সঠিক কাজ হবে। ভাস্কর্য ইস্যুতে আলেম ওলামাদের কাছ থেকে যে সব আপত্তি আসছে, সরকার সমর্থিতদের উচিত অহেতুক আবেগ তাড়িত না হয়ে এসবের একাডেমিক দিকটি কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করা। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যেমন অপরাধ, ঠিক তেমনি শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলাম বিরোধী কাজের মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা মোটেও কাম্য নয়। দেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রাণী মূর্তি ব্যতীত অন্য সকল ধরনের কারুকার্য শোভিত শৈল্পিক ভাস্কর্য নির্মাণ করা যেতে পারে। দেশের সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। তাহলেই স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মান সহজ ও সার্থক হবে।
তারিখ: ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ইং।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *