শিক্ষক নির্যাতন জাতির কলংক

নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া


শিক্ষক হচ্ছেন জাতির বিবেক ও মূল্যবোধ সংরক্ষণের ধারক ও বাহক। জাতি গঠন ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো শিক্ষা। শিক্ষকই হচ্ছেন শিক্ষাব্যবস্থা এবং জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। শিক্ষকেরা সভ্যতার অভিভাবক, সমাজ সংগঠক, সমাজের প্রতিনিধি এবং দেশ গঠনকারী। তাঁরা শিক্ষার্থীকে চরিত্র গঠনে, নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি বিকাশে এবং সমাজ বিবর্তনের অনুঘটক ও সুশীল সমাজ তৈরির প্রধান সহায়ক। স্বভাবতই শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। এক কথায় বলা যায়, শিক্ষক মানুষ চাষ করেন। যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয়ে একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে শিক্ষক শিক্ষার মেরুদণ্ড।

প্রাচীন কাল হতেই শিক্ষকতা একটা সম্মানজনক পেশা হিসাবে সবার কাছে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজ শিক্ষক সমাজ অবহেলিত ও বিভিন্নভাবে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে গত কয়েকবছরে শিক্ষক নির্যাতনের যে ঘৃন্য চিত্র উঠে এসেছে এবং বর্বরতার সকল সীমানা যেভাবে অতিক্রম করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এ পেশার মর্যাদা নিতান্তই মুখেমুখে এবং এ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময়ও হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে শিক্ষক নির্যাতনের মাত্রা অনেক গুণে বেড়েছে এবং শিক্ষকদের হেনস্তা করা একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখন স্কুল-কলেজ পর্যায়েও এসব হচ্ছে। শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে গেছে। ঢাকার সাভারে শিক্ষক হত্যা, নড়াইলে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে। এর বাইরে বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নারায়গঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মেরুদণ্ড ও জাতি গঠনের স্থপতি শিক্ষকরা আহত, নিহত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। শারীরিকভাবে প্রহারের মাধ্যমে ক্ষতবিক্ষত করা, কানেধরে ওঠবস করানো, জুতার মালা এমনকি শিক্ষকের শরীরে মানুষের মল ঢালা! এ সবই নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মানুষরুপি কিছু অমানুষ ও হায়নাদের কাছে! এসব যদি এভাবে চলতে থাকে, দেশে এমন ঘটনা আরও ঘটবে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

পরপর দুটো ঘটনা দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছে। সাভারে দশম শ্রেণির এক ছাত্র ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে তার শিক্ষককে হত্যা করেছে। অন্যদিকে নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষকে পুলিশ এবং হাজারও মানুষের সামনে জুতার মালা গলায় পরানো হয়েছে। তাঁর অন্যায়টা কী ছিল? সোস্যাল মিডিয়ায় ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি’র বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে গত ১৮ জুন দিনভর বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে। শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস অন্যান্য শিক্ষক, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে খবর দিয়েছেন এবং অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতেও তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেেন তিনি। এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল অমানুষ। শিক্ষক স্বপন কুমার গলায় জুতার মালা পরে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশেই নির্বিকার পুলিশ সদস্য। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।

অন্যদিকে গত শনিবার দুপুরে ঢাকার সাভারের চিত্রশাইল এলাকার হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে প্রভাষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র জিতুর বিরুদ্ধে। পিটুনিতে গুরুতর আহত হওয়া শিক্ষক উৎপলের মৃত্যু হয় পরের দিন। শিক্ষক উৎপল প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় জিতুকে সতর্ক করেছিলেন। এই সতর্ক করাটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ। তাই প্রকাশ্য দিবালোকে শিক্ষককে ক্ষোভের বশে হত্যা করে দিব্যি বুক উঁচিয়ে স্থান ত্যাগ করেছে জিতু। কারণ কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ চার জন সদস্য জিতুর আত্মীয়। তাদের প্রশ্রয়ে সে বেপরোয়া চলাফেরা করতো।

অতীতেও এরকম জঘন্য ঘটনা আরও ঘটেছে। এলাকার এমপি একজন শিক্ষককে চড় মেরেছিলেন এবং এ জন্য কোনো শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। যখন একজন শিক্ষককে সরকারি একজন বড় কর্তা বাধ্য করেছিলেন পা ধরে মাফ চাইতে। সে জন্যও কোনো শাস্তি হয়নি। ২০১৩ সালে পাবনায় একজন ছাত্র তথাকথিত অভিযোগে শিক্ষককে দুই হাতে ইট দিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে মারধর করা হয়েছে, জেলে নেওয়া হয়েছে। আজকে নড়াইল এবং সাভারে দুই শিক্ষকের ভাগ্যে যা ঘটেছে, এর প্রেক্ষাপট আমাদের সমাজ অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিল। ঠিক তেমনি এ দুটি ঘটনারও যদি কোনো শাস্তি না হয়; তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যতে হয়তো এর চেয়েও ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের দেখতে হতে পারে।

একজন শিক্ষকই কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট, জজ-ব্যারিস্টার কিংবা আমলা তৈরি করেন। সেই শিক্ষকের মর্যাদা আসলে আমাদের সমাজে কোথায়?

শিক্ষক লাঞ্ছনা এখন শিক্ষক হত্যায় উপনীত হয়েছে। পুলিশ পাহারায় একজন শিক্ষককে গলায় জুতার মালা দেওয়া হয়, এই হলো আজকের বাংলাদেশ। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু করে দেশের উন্নয়ন করা হচ্ছে, কিন্তু মানুষের মননের কোনো উন্নয়ন নেই।

এর অন্যতম কিছু কারণ হলো: শিক্ষক নেতাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, তেলবাজি ও স্বার্থান্ধতা, আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট ঘাটতি, নগ্ন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা।

আমাদের দেশে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা কেবলই মুখেমুখে। সাংবিধানিক বা রাস্ট্রীয় পর্যায়ে নয়। একটা বিষয় একবারে অনিবার্য ও অকাট্য যে, শিক্ষক নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্রকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে এবং তা এখনই। শিক্ষকতা পেশাকে সাংবিধানিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করা, শিক্ষক নিরাপত্তা আইন তৈরি ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা। শিক্ষকদের নির্যাতন-নিপীড়ন, অপমান করাসহ বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তপূর্বক দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দেয়া উচিত।

বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকের স্থান। একটা চরম বাস্তবতা হচ্ছে, এক সময়ে ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করত। আর এখন বলে ‘তুমি’। আগে শিক্ষককে পিতৃতূল্য মনে করা হতো। আর এখন মনে করে ‘বড় ভাই’। সমাজে এটারও একটা বিশাল প্রভাব পড়ছে।

শিক্ষকরা সমাজের বিবেক। শিক্ষকরা হচ্ছেন দেশ গড়ার প্রধান নিয়ামক শক্তি। ‘শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে; শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’ দেশব্যাপী শিক্ষকদের বৈধ অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা করা, শিক্ষকদের জীবনের মান উন্নত করার ব্যাপারে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি, শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হওয়া এবং শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *