ফান্ডের অভাবে আর্থিক সংকটে
‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’। বর্তমানে
মাত্র ২৭ জন পশশিশু রয়েছে সংগঠনে।
শুধু ডাক্তর ছাড়া সব পেশায়
কাজ করছে এ শিশুরা।
মরিয়ম জাহান মুন্নী
মো. রিপন বর্তমানে দুবায়ে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করে। যার বেতন বাংলাদেশি ৫০ হাজারের উপরে। এখন সে স্ত্রী’সহ দুই সন্তান নিয়ে সংসার জীবনে বেশ সুখেই আছেন। এই শহরেই একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছে তার পরিবার। অথচ একদিন এ রিপন ছিলেন পরিচয়হীন পথশিশু। নগরীর রেলস্টেশনে করতো ভিক্ষা। কখনো কখনো চুরি চামারিও করতো। তেমনি একদিন এক যাত্রীর মানিব্যাগ চুরি করার সময় ধরা পড়ে। একারণে কিছু লোক তাকে মেরে পুলিশের দিয়ে দেয়। পুলিশের সহযোগিতায় সৌভাগ্যক্রমে আনুমানিক ১০ বছরের রিপনের স্থান হয়েছিল চট্টগ্রামের ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটিতে। বদলে যায় তার জীবনের মোড়। সে শুরু করে পড়াশোনা। এইচএসসি পাশ করে যুব উন্নয়ন থেকে কাজ শিখে সংগঠনের সহযোগিতায় চলে যায় দুবায়ে। এখন সে অন্য সাধারণ পরিবারের সন্তানের মত জীবন নির্বাহ করছে।
শুধু রিপন নয়, ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ সংগঠনটি থেকে গত ২৩ বছরে প্রায় পাঁচ শতাধিক পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত ছেলে- মেয়ে পড়াশোনা করে হাতের কাজ শিখে কর্মজীবনে পা দিয়ে উন্নত জীবনযাপন করছে। যারা সবাই একসময় সমাজে অবহেলিত, নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু ছিল। তারা রাস্তায় কেউ ভিক্ষা করতো। কিছু শিশুর ছিলনা বাবা-মা। রাস্তায় চুরি, ছিনতাইয়ের মত নানারকম অপরাধমূলক কর্মকা-ের সাথে জড়িত ছিল। নেশা করতো।
সংগঠনটির সংশ্লিষ্টরা জানায়, ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’র আশ্রয়ে বেড়ে উঠা পথশিশুদের মধ্যে বাবা-মা পরিবার বিহীন ৯ জন ছেলে এসি, ইলেক্ট্রনিক, মোবাইল সার্ভিসিং, দর্জি, ওয়ার্কশপ, গাড়িসহ বিভিন্ন হাতের কাজ শিখে বিদেশের মাটিতে কাজ করছে। এরা সবাই এখন বিয়ে করে সুন্দর জীবনযাপন করছে। আবার ১৪ জন ছেলে মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা পেশায়, নার্স, এনজিও সংস্থায়, বিএসআরএম’র মত কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায়, ব্যাংকে চাকরি করছে। এছাড়া অনেকে হাতের কাজ শিখে বিভিন্ন কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর, ইলেকট্রনিকের কাজ, ভবন নির্মাণের ফোরম্যান হিসেবে কাজ করছে। মেয়েরা পোশাক কারখানায় চাকরি, সেলাই, ব্লক বাটিক, বিউটিফিকেশন, দোকানে বিক্রয় কর্মী হিসেবে কাজ করছে। কেউ কেউ নিজেরাই এখন ছোট মাঝারি উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ সবজি বিক্রি করে। শুধু মাত্র ডাক্তারি পেশা ছাড়া সব পেশায় এখানে শিশুরা বড় হয়ে কাজ করছে। প্রায় ১০ হাজার পথশিশুর পরিচয় খুঁজে তাদের পরিবারের কাছে দেয়া হয়েছে। এসব ছেলে মেয়েগুলো যদি সে সময় অপরাজেয় বাংলাদেশ’র আশ্রয় না পেত হয়তো তারা নানা অপকর্মের সাথে জড়িয়ে যেত। ধ্বংশ হত জীবন। এমন আলো ছড়ানো সংস্থাটি এখন প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেকারণে চট্টগ্রামের তিনটি শেল্টার হোম বন্ধ হয়ে বর্তমান কোতোয়ালী জেল রোড আনসার ক্লাবের ৩য় তলায় মাত্র একটি শেল্টার হোম আছে। কমেছে এ শিশুদের সেবার পরিধি।
সংগঠনের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা জানায়, ফান্ডের অভাবে আর্থিক সংকটে রয়েছে। যে কারণে শিশুদের নিরাপদে থাকার সুব্যবস্থা থাকলেও পথশিশুদের সংখ্যা বাড়াতে পারছে না ঐতিহ্যবাহী পথশিশুদের সংগঠন অপরাজেয় বাংলাদেশ। বর্তমানে এলাকার স্থানীয় প্রতিনিধি ও অল্প কয়েক বিত্তবানের সহযোগিতায় এ শিশুদের দু’বেলা খাবার চলছে। এছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সহযোগিতায় শিশু-কশোররা এলাকার বিভিন্ন স্কুলে পড়ছে। জানা যায়, চলতি বছর চট্টগ্রামের এ সংগঠনের দুই ছাত্র এইচএসসি’তে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করেছে। বর্তমানে তারা বিভিন্ন কলেজে ভর্তির চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথায় থেকে আসবে তাদের পড়াশোনার খরচ? অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেও তাদের কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হচ্ছে সংগঠনের পক্ষ থেকে।
অপরাজেয় বাংলাদেশ চট্টগ্রাম জোনের ইনচার্জ জিনাত আরা বেগম বলেন, একসময় বিদেশি ফান্ড থাকায় পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে অনেক কাজ করেছে সংগঠনটি। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে করোনার কারণে অপরাজেয় বাংলাদেশ’র কোনো বিদেশি ফান্ড নেই। যে কারণে আমাদের যে সেবা কার্যক্রম ছিল সেটি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন মাত্র ২৭ জন ছেলে মেয়ে আছে। তাদের ভরণপোষণ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। অথচ সংগঠনটি চট্টগ্রামে ২৩ বছর দরে কাজ করছে। প্রতিদিন দু’শতাধিকের বেশি পথশিশুকে খাবার দেয়া হত। এ ২৩ বছরে প্রায় ১০ হাজার পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোর এখান থেকে পড়াশোনার একটা পর্যায় স্বাবলম্বী হয়ে কাজ নিয়ে এখন থেকে বেরিয়েছে।
তিনি বলেন, একটা শিশুকে এখানে আনার পরে আগে তাকে ভালোভাবে কাউন্সিলিং করা হয়। তারপর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। একটা পর্যায় তাদের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও সংস্থার আওতায় বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারা যখন নিজেরা স্বনির্ভর হতে পারে তখন তাদের বের হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আগের মতই কাজ করতে চাই। এ জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।