নবযাত্রা প্রতিবেদক
#দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমান
মজুরিতে সংসার চালাতে হিমশিম
খাচ্ছেন দর্জিরা।
#বাড়তি সেলাইয়ের দামে
নাকাল কাস্টমার।
#পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায়
চলে যাচ্ছেন দর্জিরা।
মরিয়ম জাহান মুন্নী
সেলাই মেশিনে দুই পা দুলিয়ে একটি ডিজাইনিং থ্রিপিস সেলাই করছেন আনুমানিক ২৫ বছরের তুহিন। খানিকটা ঝুঁকে গভীর মনযোগে সেলাই করছেন সে। কী কাপড়? দামইবা কত? কার গায়ে উঠবে এই পোশাক? এসব ভাবনার সময় নেই তাঁর। পেছনে লাইন ধরে বসে একইভাবে নানা রঙ্গের পোশাক সেলাই করছেন আরো তিন সহকর্মী। তাদেরও যেন কোনো দিকে তাকানোর জো নেই। চারদিকে সেলাই মেশিনের এমন খটখট শব্দে মুখোর নগরীর চকবাজার এলাকার চকভিউ সুপার মার্কেটের দর্জি দোকনগুলো। তবে শুধু এ মার্কেটেই নয়, আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে নগরীর বিভিন্ন মাকের্টের দর্জি দোকানসহ অলিগলির মধ্যের দর্জি দোকানগুলোতে বেড়েছে ব্যস্ততা।
তবে গত চার বছরের ব্যবধানে পোশাক সেলাইয়ের দাম বেড়েছে ৯২ দশমিক ৩১ শতাংশ। এরমধ্যে মেয়েদের নরমাল পোশাকের বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। ডিজাইনিং পোশাকে বেড়েছে ১০০ শতাংশ। ছেলেদের শার্টে বেড়েছে ১০০ শতাংশ এবং প্যান্টে বেড়েছে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
সেলাইয়ের দাম বাড়ার বিষয়ে নগরীর বিভিন্ন মার্কেটে অন্তত ১০ জন দর্জির সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ঈদকে কেন্দ্র করে কিছুটা বেড়েছে কাজের ব্যস্ততা। তবে করোনার আগের ঈদের এসময় যে ব্যস্ততা ছিল সেটি এখন অর্ধেকে নেমেছে। এদিকে গত কয়েক বছরের তুলনায় এখন বেড়েছে শ্রমিকের মুজরি, বকমর, বোতাম, সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম, বিদ্যুৎবিল, দোকান ভাড়াসহ প্রায় সব আনুসঙ্গিক জিনিসের দাম। যেকারণে সেলাইয়ের দামও বেড়েছে। কিন্তু আগে যেমন একজন দর্জি দৈনিক ৩-৪ টা থ্রিপিস সেলাই করতো এখনো সেই একজনে ৩-৪ টা পোশাকই সেলাই করে।
চকবাজারের রাঙ্গুনিয়া টেইর্লাসের মালিক মোহাম্মদ জালাল বলেন, পোশাক সেলাইয়ের মজুরি বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু ভোগ্যপণের যে দাম তার সাথে মিলিয়ে মজুরি বাড়েনি। যেকারণে এখন সেলাই কাজ করে সংসার চালাতে পারিনা। এদিকে আগেও একজন শ্রমিক দিনে ৩-৪টা থ্রিপিস সেলাই করতো এখনো সেই একই কাজ করতে পারে একজনে। সেলাইয়ের দাম বাড়লেও লাভ সীমিত। যেকারণে খরচ সামলাতে না পেরে গত কয়েক বছরে অনেক দর্জি কাজ ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় এবং বিদেশে পাড়ি জামায়। এছাড়া নারীরা এ পেশায় এতো বেশি এসেছে তারা ঘরে বসেই সেলাই কাজ করছে। এতে পুরুষদের কাজের পরিধি কমে যাচ্ছে।
সরেজমিনে নগরীর চকবাজার, জিইসি মোড়, মিমি সুপার মার্কেট, বহদ্দারহাটসহ অলিগলির বিভিন্ন টেইলার্স এন্ড এমব্রয়ডারীর দোকানে কথা বলে জানা যায়, এখন নরমাল থ্রিপিস সেলাই হচ্ছে সাড়ে ৩শ’ টাকা, ডিজাইন করা পোশাক (থ্রিপিস, গাউন, লেহেঙ্গা) ৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা এবং ভেতরে ক্রিমার সংযুক্ত থ্রিপিস, ফোরপিস সেলাই হচ্ছে ৫শ’- ৮শ’ টাকা। আবার ছেলেদের শার্ট ৫শ’-৬শ’, প্যান্ট সেলাই ৬৫০-৭৫০ টাকা এবং পাঞ্জাবি সেলাই ৭শ’ থেকে ১৫শ’ পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। পোশাক সেলাইয়ের এ চিত্র আবার সেন্ট্রাল প্লাজাসহ বিভিন্ন নামিদামি মার্কেটে এর চেয়ে বেশি। সেন্ট্রাল প্লাজার বিনি টেইলার্স এন্ড ফ্যাশেনে মেয়েদের নরমাল থ্রিপিস সেলাই ৫০০ টাকায় এবং ডিজাইনের কাপড় ৭০০ টাকা রাখা হচ্ছে। একই চিত্র মিমিসুপার মার্কেটেও দেখা যায়।
জিইসি মোড়ে ছেলেদের খাজা টেইর্লাস এন্ড ফেব্রিকে শার্ট ৬শ’ টাকা এবং প্যান্ট ৭৫০ টাকা এবং পাঞ্জাবি ৮৫০ টাকা দাম রাখা হচ্ছে।
অথচ তুলনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে নরমাল থ্রিপিস সেলাই ছিল ২শ’ টাকা, ডিজাইন ৪শ’ টাকা। ছেলেদের শার্টপিস ৩শ’ টাকা, প্যান্টপিস ৪শ’ টাকা এবং পাঞ্জাবি ৫শ থেকে ৮শ’ টাকা ছিল।
চকবাজারের তরুণী টেইলার্স এন্ড এমব্রয়ডারী’তে কর্মী বলেন, আগের চেয়ে আমাদের বেতন বেড়েছে ঠিকই কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমান মজুরিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।
শুধু দর্জিরাই নন, টেইলার্সের মালিকেরাও এখন চিন্তিত। বহদ্দারহাট হক মার্কেটের অন্তরা টেইর্লাসের মালিক মো. নাজিম বলেন, মানুষের হাতে টাকা না থাকায় পোশাকের বিলাসিতা কমে গেছে। প্রয়োজনটুকু মেটাতেই হিমশিম অবস্থা। যেকারণে আগের মত ব্যস্ত নেই। ১৯৮৪ সাল থেকে এ ব্যবসায় আছি। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময়ের পর সব কিছু স্বাভাবিক হয়েও এমন মন্দা ব্যবসা দেখিনি। অথচ আগে ঈদের এসময়ে দম পেলার সময় থাকত না। রাত জেগে কাজ করতে হত। এখন কাজ কমে যাওয়ায় মধ্য রাতের আগেই বাড়ি চলে যাই। আবার ১৫ রোজার পরে কাস্টমার ফিরিয়ে দিতে হতো। এখন এসব কথা যেন ইতিহাস।
সেন্ট্রালপ্লাজার নিউ সৌদিয়া টেইলার্সে স্বত্বাধিকারী জাহেদ বলেন, নারীদের মধ্যে স্টিচ কাপড়ের (সেলাই করা) চাহিদা বাড়ছে। স্টিচ পোশাক কিনে দর্জির দোকানে এসে ফিটিং করে নিয়ে যান। পুরুষের বেলায়ও তাই। একারণেও সেলাইয়ের কাপড় কমেছে।
দোকানে পোশাক সেলাই করতে এসেছেন শাহনাজ এবং ফারদিন সুলতারা দুই বোন। তারা বলেন, একটা জামার কাপড় কেনা যা এখন সেলাইও তাই। সেলাইয়ের দাম দেখে এখন আর আনস্টিস পোশাকগুলো নিতে ইচ্ছে করে না। এখনো ভাবছি নিজেই সেলাইয়ের কাজ শিখে পেলবো। লাগাম ছাড়া দাম বলছে টেইলার্সরা। সামনে ঈদ সেলাই না করেও পারছি না।