নয় মাসে উপলব্ধির বাসিন্দা আরো চার কন্যাশিশু

একজনকে তার পরিবারের
কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
পেট ভরে দু’বেলা ভাত খেতে পারবে লামিয়া। তাই মাত্র নয় বছরের পিতৃহীরা লামিয়াকে মা অন্যের বাসায় কাজে দেয়। কিন্তু কাজের বিনিময়ে নিরাপদে দু’বেলা ভাত খাওয়ার ভাগ্য হলো না তার। সামান্য কাজের ভুল হলেই কারণে- অকারণে গৃহকত্রী বেধড়ক মারধর করতো ছোট্ট মেয়েটিকে।
তবে একদিন মেয়েটিও সুযোগ বুঝে খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া পাখির মত উড়াল দেয়। কিন্তু জানতো না তার গন্তব্য কোথায়। কারণ তার বাবা মা ছিল ভাসমান। প্রায় সপ্তাহখানেক নানা কাঠঘট পড়িয়ে লামিয়ার স্থান হয় কন্যা শিশুদের আশ্রয় কেন্দ্র উপলব্ধির নতুন ঠিকানা পশ্চিম খুলশী আবাসিক এলাকায়। জীবনও কাটছে বেশ আনন্দে। এখন সে পড়াশোনা করছে, নাচ, গান শিখছে। শুধু লামিয়াই নয়, চলতি বছরের নয় মাসে সংগঠনটির বাসিন্দা হয়েছে আরো চার কন্যাশিশু। যাদের বয়স ৯ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে একজন মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে বাবা আরেকটি বিয়ে করে। সৎ মা তাকে খুব অত্যাচার করতো। একদিন মেয়েটিকে ঘর থেকে বের করে দেয় সৎ মা। তখন এলাকারই একজন উপলব্ধিতে তাকে নিয়ে আসে। আরেকজন ভিক্ষাবৃত্তি থেকে পুনর্বাসন করা হয় এবং সর্বশেষ দুই মাস আগে আরেকটি মেয়ে রাস্তায় খুঁজে পেলে তারও ঠিকানা হয় উপলব্ধিতে।
উপলব্ধির তথ্য মতে বর্তমানে সব মিলে ৬৫ জন কন্যাশিশু ও কিশোরী আছে। এরা সবাই এমন লোমহর্ষক ঘটনায় স্বীকার হয়ে এখানে এসেছে। মূলত ৫ লোমহর্ষক সমস্যায় পড়ে এখানে পৌঁছায় তারা। এরমধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে অভাব। অভাবের কারণে পরিবার তাদের বাসা বাড়িতে কাজে পাঠায়। সেখানে শারীরিক নির্যাতনে স্বীকার হয়ে পালিয়ে যায়। পরিবারের অশান্তির কারণে অনেকে হারিয়ে যায়। নিজের খাবার জোগাড় করতে ভিক্ষাভিত্তি করে, কোনোভাবে পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া এছাড়া অনেক মেয়েকে রাস্তায় পেলে যায়। এসব সমস্যার স্বীকার হয়ে মেয়েগুলো কোনো না কোনোভাবে এখানে এসে পৌঁছায়।


ছোট্ট লামিয়ার এপর্যন্ত আসার গল্পটা বলেন উপলব্ধির সেন্টার ম্যানেজার ও সংগঠনের কন্যাদের ‘মা’ শেলী রক্ষিত। তিনি বলেন, যেহেতু লামিয়ার বয়স নয় তার সব কিছুই স্পষ্ট মনে আছে। লামিয়াকে আমরা বাকলিয়া থানার মাধ্যমে পাই। তার থেকে জানতে পারি, লামিয়া নোয়াখালীর কোনো এক শহরে বাসায় কাজ করতো। কিন্তু গৃহকর্তৃ কাজে একটু ভুল হলেই তাকে খুব মারতো। এভাবে যেদিন সে পালিয়ে যায় তার একদিন আগেও নাকি তাকে খুব মেরেছে। তবে সে ঠিক কত দিন ওই বাসায় কাজ করেছে এটা বলতে পারেনি। পরের দিন টমেটোর সস কিনতে দোকানে পাঠালে তখনই সেই সুযোগে কোনো একটি বাসে উঠে পড়ে। এভাবে সে সম্ভবত লোহাগাড়ায় এসে পৌঁছায়। তখনই ড্রাইভার হেল্পার তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। অচেনা অজানা জায়গায় দাঁড়িয়ে কান্না করে। এমন সময় কিছু মানুষ তার বাড়ি কোথায় জানতে চায়। সেখানের কেউ একজন তাকে পটিয়ার নিয়ে যায়। এসব জায়গার নাম লামিয়াই বলছে। পটিয়ায় যার সাথে এসেছে তার বাড়িতেও নাকি সে তিন দিন থেকেছে পরিবারের সাথে। পরে তারাও লামিয়াকে রাস্তায় ছেড়ে দেয়। এবারও সে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কান্না করতে থাকে। তবে এবার কোনো এক ব্যক্তি তাকে গাড়িতে করে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানায় পুলিশের কাছে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বাকলিয়া পুলিশ নয় মাস আগে উপলব্ধিতে লামিয়াকে পাঠায়। তখন থেকেই সে উপলব্ধিতে আছে।
লামিয়ার সাথে কথা বলে জানা যায়, তার বাবাকে সে নৌকা চালাতে দেখেছে। মা মাছের জাল সেলাই করতো। তবে এক দিন বাবা মারা যায়। এরপর মা তাদের চার ভাইবোনকে ঠিক মত ভাত খেতে দিতে পারতো না। একারণে তাকে বাসার কাজে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে তাকে প্রতিদিনই মারধর করতো। দু’বার তার হাতও পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই সে একদিন সেখান থেকে পালিয়ে একটি গাড়িতে উঠে যায়।

লামিয়া বলেন, আমার নাচতে ভালো লাগে। গানও শিখছি। আবার স্কুলেও যাই। এখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করছি। আমি বড় হয়ে শিল্পী ও শিক্ষক হতে চাই।
কথা হয় (ছদ্মনাম) তুলি (১২) সাথে। বাবা মা কেউ নেই। তবে মারা যায়নি। তারা কোথায় চলে গেছে। আমি ভিক্ষা করতাম। পরে এখানে চলে আসি। এখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি।

(ছদ্মনাম) লায়লার বিষয়ে শেলী রক্ষিত বলেন, মাকে তার বাবা তালাক দিয়েছে। মা-বাবা দু’জনেই বিয়ে করে। মেয়েটি বাবার সাথে থাকতো। সৎ মা তাকে খুব মারতো। সেদিন দুইটা বিস্কুট খেয়ে ফেলায় খুব মেরেছে। ঘর থেকে বের করে দেয়। পরে কেউ একজনের মাধ্যমে এখানে আসে।

উপলব্ধির প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইজাবুর রহমান বলেন, সব মেয়েদেরই আমরা আইনের মাধ্যমে এখানে স্থান দিই। এখানে আসার পর তাদের থেকে পরিবারের কথা জেনে তাদের পরিবারকে খোঁজার চেষ্টাও করি। পেলে তাদের সাথে আলাপ করি। দেখে, শুনে, বুঝে, যদি নিরাপদ মনে হয় তবে তাদের আমরা পরিবারের কাছে আবারও আইনের মাধ্যমে স্থানান্তর করি। যদি মেয়েরা যেতে চায় তবে। কিন্তু যদি পরিবার ঠিক না থাকে তাদের রেখে দেয়া হয়। চলতি বছর যে চারটি মেয়ে এসেছে তাদের মধ্যে একজন যার ঘরে সৎ মা আছে তাকে তাঁর বাবা আবার এসে নিয়ে গেছে।
এসময় তিনি বলেন, আমরা ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় উপলব্ধির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের নিজস্ব জায়গা পশ্চিম খুলশী আবাসিক এলাকায় সংগঠনটিকে নিয়ে এসেছি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *