নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় করণীয়

নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া

৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী এই দিনটি নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃৃতিক ও রাজনৈতিক সাফল্য উদযাপনের পাশাপাশি নারীর সাম্যতার অগ্রগতি এবং সর্বত্র নারীর পরিস্থিতি আরও উন্নত করার চেষ্টা ও প্রয়োজনীয়তার জন্য উদযাপন করা হয়।

নারী অধিকার বলতে বোঝায় নারীর এক ধরনের স্বাধীনতা, যা সকল বয়সের নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই অধিকার প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ বা কোন সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন দেশে নারী অধিকারের বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা ও পার্থক্য দেখা যায়, কারণ এটি পুরুষ অধিকার থেকে ভিন্ন। নারী অধিকার গুলো সমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা কেন্দ্রিক। যেমন: ভোটদানের অধিকার, অফিস-আদালতে একসাথে কাজ করার অধিকার, কাজের বিনিময়ে ন্যায্য প্রতিদান পাবার অধিকার, সম্পত্তি লাভের অধিকার, শিক্ষার্জনের অধিকার, সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অধিকার, আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণের অধিকার, বিবাহ, অভিভাবক ও ধর্মীয় অধিকার। নারীরা কিছুটা হলেও পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের স্বপক্ষে বিভিন্ন প্রকার ক্যাম্পেইন ও কর্মশালা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। সব কল্যাণকর বিষয়ে নারী-পুরুষের অবদান সমান। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর অবদান বেশি। তারপরও সমাজে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেয়া হয় না। নারী-পুরুষ সমঅধিকারের বিষয়টি এখনও কাগজে-কলমেই আছে। অথচ দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে নারী নেতৃত্ব চলে এসেছে, তারপরও নারী অধিকার বলতে যা বোঝায় তা অনুপস্থিত। নারী নেতৃত্বের দেশে নারীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে এবং চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। নারী নেতৃত্ব থাকার পরও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৮২৯ সালে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করেছেন, ১৮৫৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করেছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নিজের জীবন দিয়েছেন। মহান ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে নারীর সরাসরি অংশগ্রহন অবিস্মরণীয়। এত কিছুর পরেও আমরা নারীকে তাঁর প্রকৃত সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করছি কেন? বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষার হার বেড়েছে, চিন্তাধারার উন্নতিও হয়েছে। তবুও তারা মুখে নারী অধিকারের কথা বললেও ঘরের নারী সদস্যকে বাইরে চাকরি করতেই দিবে না, বিয়ের সময় মেয়ের বাবাকে যৌতুক দিতে হবে এই কুপ্রথাগুলো সমাজে বিরাজ করছে। সব ধর্মেই নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তারপরও বাস্তব জীবনে অধিকাংশ নারী তাদের যোগ্য সম্মান পায় না। দেশের অর্ধেক মানুষ নারী। তাদের অগ্রাহ্য করে দেশ ও জাতির উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। নারীর অধিকার কখনও আপসে কেউ দেয় নি। নারীদেরই তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রত্যেক মেয়েকেই শিক্ষিত হতে হবে। যে নারী পরিবারের সমর্থন পাবে, তার চলার পথ সহজ হবে। নারীকে এ সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আর আমাদের পুরুষদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও সহিংসতা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের কারণে নারী অধিকারের জায়গাটি খুবই তমসাচ্ছন্ন হয়ে যায়। তাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের জন্য জাতীয় সংসদসহ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। নারীর প্রশ্নে সবাইকে এক থাকতে হবে এবং এ জন্য বেছে নিতে হবে অসাম্প্রদায়িকতার নীতি।

নারী অধিকার মানবাধিকার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। এটি নারীকে তার আপন সত্তায় উদ্ভাসিত করে নিজস্ব মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে শেখায়। বাংলাদেশে নারীদের সম অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। আমাদের সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা আছে, সব নাগরিক সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকেরই সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে। সেখানে রাষ্ট্র নারী পুরুষের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য রাখবে না। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্নতা। ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে নারী তার প্রাপ্য অধিকারটুকুও পায় না। নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজ করছে সমাজের সব ক্ষেত্রেই। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও বিরাজ করছে এ বৈষম্য। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে নারীর সমান অংশীদারী থাকলেও তাদের নিজেদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা বৈষম্য দেখি। সব ধরনের অবহেলাই যেন নারীর নিয়তি। বঞ্চনা আর অধিকারহীনতাই নারীর বাস্তবতা। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে নারীর এ বাস্তবতা আরো প্রকট।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নারী অধিকার রক্ষায় গৃহিত হয়েছে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ সনদ স্বাক্ষরও করে। কিন্তু আমাদের দেশে এর বাস্তবায়ন এখনো সুদূর পরাহত। সিডও অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নারীবান্ধব উন্নয়ন নীতি ও আইন প্রণয়ন করার জন্য বদ্ধ পরিকর। আইনানুযায়ীই রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ডে নারীর ক্ষমতায়ন এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে প্রয়োজন সেই অধিকারকে রক্ষা করা। এছাড়া নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধে পৃথক আইন থাকাও জরুরি। আমাদের সে রকম আইন প্রচুর আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এসিড সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২ ও যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, নারীনীতি আইন ২০১১ ইত্যাদি। আমাদের দেশে বিভিন্ন কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়েনি। মূল বিষয় হলো ব্যক্তি পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন। সেখানে পিছিয়ে আছে নারীরা। তাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ও ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার। রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভ’মিকা পালন করতে হবে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় নারী তথা জনগণের ক্ষমতায়ন। নারী আজও পুরুষের মতো পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। এজন্য পরিবার, রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক সাথে কাজ করতে হবে। কোনো সীমাবদ্ধতা ছাড়া নারী যদি নিজেদের জীবন ধারা পরিবর্তনের সকল সুযোগ-সুবিধা পায় তবেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

তারিখ : ৭ মার্চ, ২০২১ ইং।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *