মরিয়ম জাহান মুন্নী
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন মানুষ পানিতে পড়ে মারা যায়। এরমধ্যে মাত্র পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুই মারা যায় ৩০ জন। দেশে ২০২২ সালে পানিতে ডুবে নয় বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার বেড়েছে। এ সময় পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে ৮১ শতাংশের বয়স ছিল নয় বছরের কম। যা আগের বছরের তুলনায় এ হার ৮ শতাংশ বেশি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’।
সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, পানিতে ডুবে শিশু মুত্যৃর দিক থেকে বাংলাদেশে শীর্ষে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা। ২০২২ সালে এ জেলায় ৭৩ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়াও বিভাগের দিক থেকেও সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম। একই সময়ে এ বিভাগের বিভিন্ন জেলা- উপজেলায় সর্বোচ্চ ২৮২ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। দ্বিতীয় শীর্ষে রয়েছে রংপুর বিভাগ। এ বিভাগে ১৬০ জন মারা যায়, ঢাকায় ১৪৯ জন, বরিশালে ১৩১ জন, রাজশাহীতে ১১০ জন, ময়মনসিংহে ১০৪ জন, খুলনা বিভাগে ১০৩ জন ও সিলেট বিভাগে ৯১ জন মারা যায়। ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এছাড়া চার বছর বা কম বয়সী ৫৫৬ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩৬৩ জন, ১০-১৪ বছরের ১০২ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৪৩ জন। ৬৬ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি। গত ১২ মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত পানিতে ডুবে ১ হাজার ১৩০টি মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে ২০২০ ও ২০২১ সালে নয় বছর বয়সীদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার ছিল যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ ও ৭৩ শতাংশ। এ দু’বছরে যথা ক্রমে ৮০৭ ও ১ হাজার ৩৪৭টি মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুসারে ২০২২ সালে সারাদেশে পানিতে ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। এছাড়াও মৃত্যুর দিক থেকে এগিয়ে আছে পুরুষ শিশুরা। দ্বিতীয় অবস্থানে কন্যাশিশু। বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর প্রায় ৬৮ শতাংশ ঘটে সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১ টার মধ্যে। যে সময়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিশেষ করে মায়েরা গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত থাকেন। মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ঘর থেকে মাত্র ২০ গজ দূরত্বের মধ্যে।
সমষ্টি’র দেয়া তথ্যে গত ১ বছরের হিসাবে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে আগস্ট মাসে। এ মাসে সারাদেশে ১৬২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া জুন মাসে ১৪৩ জন এবং মে ও সেপ্টেম্বর মাসে ১২৮ জনের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মীর মাসরুর জামান বলেন, শতকরা ৭১ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সাঁতার না জানার কারণে। মৃত্যুর আরো একটি প্রধান কারণ প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতী সম্পর্কে মানুষের ধারণা না থাকা। গ্রামাঞ্চলে এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানারকম কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। তারা সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে কুসংস্কারের দিকে ঝুঁকে। এতে মুত্যৃ হার বেড়ে চলেছে।
তিনি বলেন, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া এ শিশুদের মধ্যে মাত্র তিন ভাগ শিশু বেঁচে আসে। কিন্তু এ শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই পরবর্তীতে প্রতিবন্ধী হয়ে জীবন কাটায়। এদের মধ্যে কেউ কানে শুনে না, কেউ বা আবার মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়।
পরিচালক মীর মাসরুর জামান বলেন আরো জানান, দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যেই শিশুরা বেশি মারা যায়। তারপর দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগে, এছাড়া সন্ধ্যার সময় কিছু মারা যায়। এরজন্য বেশি মায়েদেরকেই দায়ী করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর মধ্যে অনেকগুলো উন্মুক্ত জলাশয় আছে। যেগুলোতে সেই কোনো ঘেরা-বেড়া। এসব জলাশয়ে গরমের সময়ে শিশুরা গোসল করে। এতেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে নগরীর বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটার এমনি একটি পুকুরে ফাহিম (৫) ও তানভির (৭) নামের দু’জন ছেলে এক সাথে পানিতে ডুবে মারা যায়। গরমের মৌসুম হওয়ায় তারা দুপুরে পুকুরে দল বেধেঁ গোসল করতে যায়। এসময় ফাহিম পানির গবীরে চলে গেলে তাকে বাঁচাতে গিয়ে তানভিরসহ দু’জনেই ডুবে মারা যায়। এছাড়াও এ জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশে রয়েছে পুকুর ও জলাশয়। কিন্তু এসব পুকুর ও জলাশয়গুলোতেও নেই ঘেরা বেড়া। পাশাপাশি বাচ্চাদের ঠিকমতো নজরদারি করেন না অভিভাবকরা। এতেই বাড়ছে চট্টগ্রামে মৃত্যুর হার।
গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটর কমিউনিকেশন ম্যানেজার মো. সারোয়ার ই আলম বলেন, গতবছর এ সময়ে সারাদেশে ৪৯টি পরিবারের ৯৮ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের মধ্যে জমজ শিশু ছিলো ১৪ জন। এছাড়া শিশুর সঙ্গে ভাই অথবা বোনসহ ৪২ জন, চাচাতো, মামাতো বা খালাতো ভাই বা বোনসহ ৪২ জন মারা যায়।
তিনি আরো বলেন, গত বছর পানিতে ডুবে নিহতদের মধ্যে সারাদেশে ৪১২ জন ছিল নারী। এদের মধ্যে কন্যা শিশুই ৪০০ জন। পুরুষ মারা যায় ৭০৮ জন, যাদের মধ্যে ৬৬৪ জনই পুরুষ শিশু। এছাড়া প্রকাশিত সংবাদ থেকে ১০জনের লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মৃত্যুর কারণ: সারাদেশে মৃতদের মধ্যে ৯৯০ জন কোনো না কোনো ভাবে পানির সংস্পর্শে এসে ডুবে যায়। ১৪০ জন মারা যায় নৌ যান দুর্ঘটনায়। পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নজরাদারি না থাকায় সবচেয়ে অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
পানিতে ডুমে মৃত্যুর প্রতিকার, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষার আওতায় নেয়া প্রকল্পের অধীনে দেশের আট বিভাগের ১৬টি জেলায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পে সুপারিশগুলো হল- জরুরি ভিত্তিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা ও ৫ ইয়ার প্লানে ডুবে মৃত্যর বিষয় যোগ করা। এসময় এ শিশুদের জন্য ‘আঁচল’ (সমম্বিত শিশু বিকাশ ও দিবাযন্ত্র কেন্দ্র) ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) তত্বাবধায়নে পরিচালিত ‘আঁচল’ শিশুদের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া তাদের সাঁতার শেখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব উদ্যোগ সফলভাবে মানা গেলে ও পারিবারের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।