সেনা অভ্যুত্থানে পদদলিত মিয়ানমারের গণতন্ত্র

নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া
বিশ্বজুড়ে সামরিক শাসনের জন্য মিয়ানমারের বিশেষ কুখ্যাতি ছিল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর গত ৭২ বছরে মিয়ানমার মাত্র ১৫ বছরের মতো বেসামরিক সরকারের অধীনে থেকেছে। সেনাশাসন আবারও জেঁকে বসেছে দেশটিতে। ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নতুন পার্লামেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করেছে দেশটিতে। স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে আটকের পাশাপাশি শাসক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রায় সব পরিষদ সদস্যকে বন্দী করা হয়েছে একই সঙ্গে। এর কয়েক দিন আগে থেকেই মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের গুজব চলছিল। অনেকে এটা বিশ্বাস করেনি। উদীয়মান গণতন্ত্রকে সেনাবাহিনী গলা টিপে হত্যা করবে এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। সেনাবাহিনী সব ক্ষমতা তার এখতিয়ারে নিয়ে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে এবং তারা বলছে সংবিধান অনুযায়ীই ক্ষমতা নিয়ে একজন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরে নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছিল সুচি’র সরকার। করোনার মধ্যেও অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ভোট দেন। এরমধ্যে ৮৩ শতাংশ মানুষ এনএলডিপিকে ভোট দেয়। মিয়ানমারে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোতে ১ হাজার ১৭১টি আসনের মধ্যে এবার ভোট হয়েছিল ১ হাজার ১১৭ আসনে এবং তাতে সুচির দল একাই পেয়েছে ৯২০ আসন, যা গতবারের চেয়েও ৬৬টি বেশি। সেনাবাহিনী সমর্থক রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) মাত্র ৭১টি আসন পায়, যা গতবারের চেয়ে ৪৬টি কম। নির্বাচনে কারচুপি-জালিয়াতির অভিযোগ তুলে তা তদন্তের দাবি করেন সামরিক বাহিনী এবং ইউএসডিপি, একইসাথে এই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবি তোলেন তারা। এছাড়া ভোটার তালিকা যাচাই এবং তা প্রকাশ করতে নির্বাচন কমিশনকেে আহবান জানিয়েছে সেনাবাহিনী। আবার কয়েক মেয়াদে দেশটিতে রাজনীতিবিদদের বেসামরিক সরকার কাজ করলে সশস্ত্র বাহিনীর কর্তৃত্ব কমে আসার যে প্রবণতা শুরু হবে, জেনারেলরা সেটা হতে দিতে চাইছে না। এই কারণে ভোটের পর থেকে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে অভিযোগ করে এ অভ্যুত্থান ঘটান সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল গঠনের পর নতুন ১১ জন মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে এবং সুচি সরকারের ২৪ জন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নতুন মন্ত্রীদের অধিকাংশই সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা এবং সেনা সমর্থিত দল ইউএসডিপির সদস্য। জেনারেল হ্লাইং হয়েছেন স্টেট লিডার। সুপ্রিমকোর্টের সাবেক আইনজীবী, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইয়াঙ্গুনের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মিয়ন্ট সোয়েকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সোয়ে টুটকে। তিনি মিয়ানমার গোয়েন্দা সংস্থার সামরিক নিরাপত্তা বিভাগের সাবেক প্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সময় থেকে কর্মরত। পররষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সামরিক বাহিনীর সদস্য, সাবেক কূটনীতিক ও ইউএসপিডির অন্যতম নেতা উন্না মং লুইংকে। জানা গেছে তিনি নভেম্বরের নির্বাচনে হেরেছিলেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানানো হয়েছে জেনারেল মিয়া তুন ও’কে। হ্লাইংয়ের পর জেনারেল মিয়া তুন সামরিক বাহিনীর প্রধান হতে পারেন বলে আলোচনা রয়েছে। বর্তমানে তিনি সামরিক বাহিনীর উচ্চপদে কর্মরত। সামরিক প্রশাসনের শীর্ষ এ কর্তারা মিয়ানমারে ক্ষমতাধর হিসাবে পরিচিত। এমন শঙ্কাও ছিল জেনারেল মিন অং হ্লাইং অবসরে গেলে তিনি ও অন্যান্য জেনারেলদের রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে চলমান আন্তর্জাতিক বিচারে সুচি আর সুরক্ষা নাও দিতে পারেন। আগামী বছরই জেনারেল মিন অংয়ের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। মিয়ানমারের অভ্যুত্থানের পেছনে চীনের ইন্ধন রয়েছে বলেও সবার ধারণা। সেনাবাহিনী যে কারণে সুচির হাত থেকে ক্ষমতা নিয়েছে, চীনও একই কারণে তাতে সমর্থন দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্ববাসীর মতোই বাংলাদেশের জন্যও মিয়ানমারের সর্বশেষ ঘটনা উদ্বেগের। এরফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনা বিলম্বিত হবে, এমনকি নিজেদের জনপ্রিয় রাখতে রোহিঙ্গা মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হতে পারে সেনাবাহিনী। আরাকান আর্মির সঙ্গে টাটমা-ডর সংঘাত বাড়তে থাকলে আরাকান থেকে আরও শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে মূল কারণ এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন-মার্কিন প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। বিদেশি হস্তক্ষেপ ও চীন-মার্কিন রাজনৈতিক প্রভাবের লড়াইয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র সুসংহত হতে পারছে না। দেশটিতে সবসময় সামরিক অভ্যুত্থানের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, আমদানি-রপ্তানি আইন ভঙ্গ এবং অবৈধভাবে যোগাযোগ ডিভাইস ব্যবহার করা। এসব অভিযোগে তার কারাদণ্ডও হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে, ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের বিরুদ্ধে করোনার বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে নির্বাচনি প্রচারনা চালানোর অভিযোগ এনেছে সেনাবাহিনী। অং সান সুচির দল এনএলডি সেনাবাহিনীর হাতে তাদের বন্দী নেত্রীর পক্ষে ফেসবুকে এক বিবৃতিতে সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ করার ডাক দিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বনেতারা। সেই সঙ্গে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচিসহ বন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দাবি করেছে। দেশটিতে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে উদ্যোগ নেওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছে নিরাপত্তা পরিষদ। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের জোট আসিয়ান তাদের সদস্য মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বিবেচনা করছে। সদস্য দেশগুলোর পক্ষ থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সরাসরি কোনো নিন্দা করা হয়নি। এদিকে সামরিক বাহিনী থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এগুলো হল: নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে এবং নিয়মানুযায়ী ভোটার তালিকা তদন্ত এবং পর্যালোচনা করা হবে; কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সামরিক সরকার যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করা হবে; দেশজুড়ে যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়া বন্ধ করতে কাজ করে যাবে সেনাবাহিনী; এবং জরুরি অবস্থা শেষে একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করবে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বলেছে, জরুরি অবস্থা শেষ হলে দেশটিতে নতুন করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। আরও বলছে, তারা প্রকৃত বহু-দলীয় গণতন্ত্র চর্চা করবে যেখানে পূর্ণ ভারসাম্য এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। সামরিকতন্ত্রের মুখে যা বলা হোক না কেন, বিশ্ব রাজনীতির অংশ হিসেবে মিয়ানমারে স্বৈরাচারী সামরিকতন্ত্র ধ্বংস করে গণতন্ত্রের মশাল জ্বলে উঠুক এই প্রত্যাশাই রইলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *