অনলাইনে শিখা, অনলাইনেই বিক্রি


শিক্ষার্থীদের আয়ের উৎস
হয়ে উঠেছে ফেসবুক পেজ।

মরিয়ম জাহান মুন্নী
সকাল থেকে ‘রেড ভেলভেট’ নামের একটি কেক তৈরিতে ব্যস্ত দুই বোন সাদিয়া আক্তার ও সাবরিনা মমতাজ। কারণ একটি গায়ে হলুদের অর্ডার পড়েছে তাদের। সন্ধ্যার মধ্যেই দিতে হবে ডেলিভারি। ফেসবুক পেজ ‘হেল্দি কেকস এন্ড ফুড’ এর মাধ্যমেই দু’বোন ব্যবসা পরিচালনা করেন। আবার অনলাইনের মাধ্যমেই শিখেছেন কেক তৈরির কৌশল। তারপর হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা।


শুধু তারাই নয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেরই এখন আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। এ মাধ্যমে একটি পেজ খুঁলে নিজেদের ক্রিয়েটিভিটি তুলে ধরেন। সেখানেই খুঁজে নিচ্ছেন আয়ের উৎস। ঘরে বসেই আয় করেন হাজার টাকা। তেমনি কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজের দুই শিক্ষার্থী দুই বোন সাদিয়া আক্তার ও সাবরিনা মমতাজ। অনলাইন মাধ্যমকে অবলম্বন করে হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। দুই বোন শখের বসেই ইউটিউবের মাধ্যমে শিখেন কেক বানানোর কৌশল। আবার সেই মাধ্যমকেই অবলম্বন করে হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। পড়াশোনার পাশাপাশি ঘরে বসেই ফেসবুকের মাধ্যমে শখের কাজ থেকে মাসে আয় করেন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন পার্টি সবখানেই দুই বোনের বানানো কেকের বেশ কদর রয়েছে।


তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাদিয়া ইউটিউবে কেক তৈরির পদ্ধতি শিখেন। তারপর উপকরণগুলো কিনে ঘরে তৈরি করার চেষ্টা করেন। প্রথম অবস্থায় ভালোভাবে তৈরি করতে পারছিলেন না। বেশ কয়েকবার পুড়েও যায়। তবে একদিন ঠিক শিখে যান। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। ভ্যানিলা, চকলেট, রেড ভেলভেট থেকে শুরু করে কাপ কেক, ঝার কেক এমন প্রায় ২০ রকমের বেশি ডিজাইনের কেক তৈরি করতে পারেন তারা।


সাবরিনা মমতাজ বলেন, বাইরে স্টুডেন্ট পড়াতে গেলে মা বাবা পছন্দ করেন না। তারা চিন্তা করেন মেয়ে মানুষ বাইরে গেলে যদি কোনো বিপদ হয়। কিন্তু বাবা মায়ের কাছ থেকে এখন আর টাকা নিতে ভালো লাগে না। নিজেদেরই কিছু করার ইচ্ছে জন্মায়। ফেসবুকের মাধ্যমে অনেককে দেখি বিভিন্ন জিনিস নিয়ে কাজ করে টাকা আয় করতে পারে। ভাবতে থাকি আমরা কি করতে পারি। আমি আর আমার বোন ইউটিউবে কেক বানানো দেখতাম। আগ্রহ জন্মায় কেক তৈরি শেখার। সেখানেই কাজটা শিখি। প্রথম অবস্থায় পুড়ে যেত। এভাবে অনেকগুলো নষ্ট করেছি। এরপর টিক হয়েছে।


সাদিয়া আক্তার বলেন, আমরা দুই বোন কাপাসগোলা মহিলা কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে একাউন্টিংয়ের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করার ইচ্ছে থেকে এ কাজ শিখি। কেকসহ নানারকম পিঠাপুলি পুডিং তৈরি করি। কেক সর্বনিম্ম ১৩০ টাকা থেকে হাজার টাকায় বিক্রি করি। পড়াশোনার পাশাপাশি ঘরে বসে ভালোই আয় হয় মাসে। এখন ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে একটি দোকান দেয়ার। প্রশিক্ষণ সেন্টার করার।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে

দাঁড়াতে পারেনি সানজিদার জীবনে

বয়স যখন মাত্রই নয় তখনই তাঁর জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। যদিও জন্মগত ভাবেই ভালো ভাবে হাঁটতে পারতেন না তিনি। কিন্তু  পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় এক দিন হঠাৎ শরীর দূর্বল হতে থাকে। তারপর আর হাঁটা হলো না। বসতে হয় হুইলচেয়ারে। বন্ধ হয়ে গেল ঘর থেকে বের হওয়া। একদিন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ঘরের বাইর হওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই সাদিয়া ইসলাম সানজিদা এখন অন্যদের অনুপ্রেরণা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে অদম্য ইচ্ছে শক্তি দিয়ে জয় করেছেন তিনি। ঘরে বসেই গুগল থেকে বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে রং তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে সেই দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। সেই আর্টগুলো ফেসবুকের সহায়তায় বিক্রি করেন। এভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন উদ্যোক্তা হিসেবে। কারো উপর নির্ভরশীল হতে হয় না। বরং নিজের আয়ে নিজেই এখন স্বাবলম্বী।


জীবনের সফলতার গল্প বলতে গিয়ে সানজিদা বলেন, এক সময় ভেবেছিলেন আমার দ্বারা কিছুই হবে না। কারণ আমি শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে আর আমার চেষ্টায় আজ আমি নিয়ে আয় করতে পারি। অসুস্থতার কারণে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। পরিবারে আমি, বাবা-মা আর ছোট্ট বোন আছে। ছোট্টবেলায় ক্রিয়েটিভ আর্ট একাডেমি থেকে আর্টের হাতে খড়ি হয়। কিন্তু অসুস্থতার জন্য বেশি দূর এগুতে পারিনি। আমার শখ হলো ঘুরতে যাওয়া আর আর্ট করা। কিন্তু আমি কোথাও যেতে পারি না। একই জায়গায় সারাদিন বসে থাকতে হয়। মাকে বলতাম আমি কি করব। মা বলে সেলাই শিখতে। মায়ের সহযোগিতায় সেলাই শিখি। নকশী কাঁথা, এমব্রয়ডারির কাজও শিখি। তারপর থেকেই নতুন আইডিয়া জেনারেট করে নানা ডিজাইনের জামা তৈরি করি। ইউটিউবে কারুশিল্পে ভিডিও দেখি। সেখান থেকে উৎসাহিত হই। এরউপর  কিছু করার ইচ্ছে জন্মায়। কার্ড, প্রাচীর ঝুলন্ত বানাই আবারো পুঁতি দিয়ে টিস্যুবক্স, কলমদানি, অক্ষর, চাবির-রিং তৈরি করি। এইভাবে আমার পথ চলা। শখের কাজগুলো ঘরে বসেই শিখি এবং করি। গুগলে বিভিন্ন প্রকৃতিক দৃশ্য দেখি। সেই দৃশ্যগুলো পরে নিজে নিজে আঁকি। আমি মা এবং আর্ট দু’টা ছাড়াই অচল।
২০১৮  সালের  দিকে শুরু  করি প্রকৃতি, ল্যান্ডস্কেপ, চিত্র, আরবী, ইংলিশ ক্যালিগ্রাফি, স্কেচ আঁকার। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে  একটি পেজ  খুলি। পেইজের নাম ‘সানজি’স ড্রিম ওয়ার্ল্ড’ ভালোলাগা আর শখের বসে আর্ট ক্রাফট শেয়ার করি। তারপর ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকে। অনেকের কাছে আমার কাজগুলো ভালো লাগতে। আমি অনুপ্রাণিত হই। অনেকে কিনতে চায়। তখন থেকে স্বপ্ন শুরু আর্টি নিয়ে কিছু করার। এখন, প্রকৃতির চিত্র, ফুল, ফল, খাবার, ল্যান্ডস্কেপ, বাস্তবসম্মত, চিত্র অংকন করি। ফার্স্ট অর্ডার ছিলো ইংলিশ নামে লোগো ক্যালিগ্রাফি। প্রথম ইনকামের টাকা দিয়ে মাকে সারপ্রাইজ দিয়েছি। তিনি খুব খুশি হয়েছেন। এভাবেই আমি উদ্যোক্তা হয়ে উঠি।


কিন্তু কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেহেতু আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী কাজের এতো অর্ডার পড়ছে কাকে দিয়ে এসব ডেলিভারি দিবে। তারউপর আমি কাস্টমারের সাথে কথা বলতে পারি না। কারণ আমি শুনতে পাই না। তবে মায়ের সহযোগিতায় সেই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠি। কাস্টমারের সাথে আমার ভাষা হচ্ছে শুধু লেখালেখি। অনেকে কথা বলতে চায়। কিন্তু আমি পারি না। এরজন্য কষ্ট হয়।
সানজিদা বলেন, আঁকা ছবি, ক্যালিগ্রাফি বিক্রি করে, নানারকম হাতের তৈরি পণ্য বিক্রি করে মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজারের বেশি টাকা আয় করি ঘরে বসেই।

IMG 20231031 WA0039

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *