মুষ্টিভিক্ষার চালে সমাজের উন্নয়নে কাজ করতেন সঞ্চিতা

কিছু পাওয়ার আশায় নয়, দুই যুগের বেশি সময় সমাজের উন্নয়ন আর পরিবর্তণে কাজ করেছি নিজের ভালোলাগা থেকে।

মরিয়ম জাহান মুন্নী

পায়ে হেটে রাত-দিন কিংবা ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চেলের পথে ছুটে চলেছেন মাইলের পর মাইল। এ ছুটে চলা নিজের জন্য নয়, বরং মানুষের কল্যাণে। বাড়ি বাড়ি মুষ্টিভিক্ষার চাল সংগ্রহ করে সেই চাল বিক্রির টাকায় সমাজের অন্ধকার দুর করতে নিজ উদ্যোগে করেন নানারকম উন্নয়মূলক কাজ। করেন ভাঙ্গা রাস্তা মেরামত। উপজেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় প্রান্তিক নারীদের স্বাবলম্বী করতে করেন নানারকম কর্মমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যান বস্ত্রহীন মানুষের পাশে শীত বস্ত্র, খাদ্য সহায়না দিতে। অসহায় দুস্থ রোগীদের জন্য তৈরি করেছেন অসহায় প্রান্তিক ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। যারমাধ্যমে গরীবদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। এছাড়াও কাজ করেন প্রতিবন্ধী নারীদের কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বনির্ভর করতে। আবার অভাবের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়া মেধাবি শিক্ষার্থীদের নেন পড়ালেখার দায়িত্ব। কাজ করেন বাল্যবিয়ে. ইভটিজিং বন্ধে। কন্যা দায়গ্রস্ত গরীব পিতার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত করেন। কিছু পাওয়ার আশায় নয়, চন্দনাইশ উপজেলার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ জোয়ারা মহীয়সী নারী সঞ্চিতা বড়ুয়া দুই যুগের বেশি সময় এভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন সমাজের মানুষের কল্যাণে।
অদম্য এই নারী শুধু ভালোলাগা থেকেই এ কাজগুলো করতেন। তাঁর নিঃস্বার্থ সেই কাজের পুরষ্কারও পেয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালে মা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলা থেকে ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান’ ক্যাটাগরিতে সেরা পাঁচ জয়িতার একজন নির্বাচিত হয়ে সম্মাননা অর্জন করেন।
সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার সম্পর্কে জানতে চাইলে সঞ্চিতা বড়ুয়া বলেন, আমার বেড়ে উঠা মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা জাতীয় ফুটবলার ছিলেন আর মা শিক্ষিকা। আজকের এই স্মার্ট বাংলাদশেরে তুলনায় তখন আমাদের বেড়ে উঠা এতোটা সহজ ছিল না। কারণ রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা, মাইলের পরম মাইল হেটে স্কুলের পড়ালেখা করতে যেতে হত। কিন্তু মনে ছিল অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাস। সবসময় ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। করণ পিতা-মাতা দুইজনের কাজ থেকে আমি অনুপ্রেরনা পেয়েছি। আমি সংস্কৃতিক অংঙ্গণের কর্মী।
তিনি বলেন, আমি যখন চতুর্থ শেণীতে পড়ি আমার জন্মস্থান পটিয়ায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে ভালো গান করায় তখনকার জেলা প্রশাসক নাজমুল হুদা আমাকে বলেছিলেন ‘মা তুমি কি চাও’। আমি বলেছিলাম স্যার আমাদের গ্রামে রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। সেটি ঠিক করে দিন। তিনি তাই করেন।
এভাবেই আমি ছোট থেকে সমাজের কোনো সমস্যা দেখলে সেটা কিভাবে সমাধান করা যায় তাই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়তাম। সমাধান না করা পর্যন্ত আমার ভালো লাগতো না। বাবাকে বলতাম, বন্ধুদের বলতাম। একটা সময় সবার সহযোগিতায় সমাধানও করতাম। করতে করতে এসব কাজ নেশায় পরিণত হয়ে গেছে। আশপাশের মানুষও দেখতাম খুশি হত। উৎসাহ পেতাম। এভাবেই সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়াতে শুরু করি। চলতে চলতে দুই যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করছি। কখনো কিছু পাওয়ার আশায় কিছু করিনি। কিন্তু অনেক সম্মান পেয়েছি। এসব না পেলেও আমার আক্ষেপ থাকতো না।
সঞ্চিতা বড়ুয়া বলেন, বিয়ের পর চন্দনাইশ স্বামীর সংসারে চলে যাই। সেখানেও বন্ধ থাকেনি আমার কাজ। কারণ আমার স্বামী আন্তরিক মানুষ ছিলেন। এখন আমি দুই সন্তানের মা। বড় মেয়ে ডাক্তার, আর ছেলে প্রকৌশলী। সমাজের কল্যাণে কাজ করতে টাকার প্রয়োজন। সেই টাকার আমার কাছে নেই। তাই কোনো সমস্যা দেখলেই বাড়ি বাড়ি মুষ্টিভক্ষার চাল সংগ্রহ করতাম। সেই চাল বিক্রির টাকায় কাজ করতাম। সামর্থবানরাও এগিয়ে আসতেন। একটা সময় এগিয়ে আসেন সাংসদ ও উপজেলার চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি। এরপর আমি নিজেই গার্মেন্টস টেক্সাটাইলের উপর ডিপ্লোমা করি। আরো কিছু উদ্যোক্তা ট্রেনিং নিই। কারণ গ্রামের প্রান্তিক মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে হলে আমাকেও জানতে হবে। এভাবে নারীদের স্বাবলম্বী করতে সেলাই, ব্লক-বাটিক, হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের উপর প্রশিক্ষণ দিই। কিভাবে উদ্যোক্ত হাওয়া যায় সেই পরার্ম দিই। এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করি। উপজেলার সাংসদ এবং চেয়ারম্যানে সহযোগিতায় প্রান্তিক মহিলাদরে মধ্যে সেলাই মেশিন দেয়ার ব্যবস্থা করি। যা তাদের কর্মমুখী হতে আরো সহযোগীতা করে। প্রতি বৎসর প্রান্তিক অসহায় মহিলেদের মাঝে শীত বস্ত্রের ব্যবস্থা করি। এটি অনেক সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েও করি এখন।
তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় অধীনে মহিলাদরে নিয়ে সৌরিতা জাগ্রত মহিলা সমিতি নামে একটি সংগঠনের নিবন্ধন পাই। যার মাধ্যমে মহিলাদের বাল্য বিবাহ রোধ, ইভটিজিং নিয়ে সচেতন, স্বাস্থ্য সচেতনতা, কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন মনের অবস্থা নিয়ে কাউন্সিলিং করি। তাছাড়া, সৌরিতা শব্দমালা নিকেতন নামে একটি একাডেমি করেছি। যেখানে গরীব শিশুদের সাংস্কৃতিক কর্মকা- করা হয়। এরপর প্রান্তিক মহিলাদের নিয়ে চন্দনাইশ উপজেলায় দুইবার উদ্যোক্তা মেলা করেছি। চন্দনাইশ উপজেলা রোগী কল্যাণ সমিতির আমি আজীবন সদস্য এবং প্রান্তিক ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের একজন ট্রাস্টি। এ সুবাধে প্রতি মাসে দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে পারি। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে প্রতিবন্ধী নারীদের কুঠিরশিল্প হস্তশিল্পের মাধ্যমে কর্মমুখী করার চেষ্টা করি। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে প্রান্তিক মহিলাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি। মায়েদের শিশুভাতা, বৃদ্ধ ভাতা, পঙ্গু ভাতা এবং তাদের হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিই।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *